শুরুর কথা :-

দেশ তখন পরাধীন। আর সেই পরাধীন ভারতবর্ষের শাসনকালে ১৯৪৪ সালে তৈরি হয় আমাদের অগ্রণী সমাজ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সংস্কৃতি সহ শহরের বিভিন্ন সমস্যায় একত্রিত হওয়ার এক প্রগতিশীল নাম অগ্রণী সমাজ। মূলত সেবা, শিক্ষা ও ক্রীড়াকে সঙ্গে নিয়ে শুরু হয় অগ্রণী সমাজের পথ চলা। আজকের এই বটবৃক্ষের বীজ সেদিন রোপণ করেছিলেন যাঁরা, তাদের মধ্যে অন্যতম সতীন্দ্র মিত্র, রেবতী মোহন সরকার, সুধীর দত্ত ও নিহার দত্ত সহ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ।
"অগ্রণী সমাজ"-এর নামকরণ করেছিলেন সতীন্দ্র মিত্র।


বাগদেবীর আরাধনা :-

১৯৪৫ সালে অগ্রণী সমাজে শুরু হয় বাগদেবীর আরাধনা। সেই সময় সরস্বতী পুজো উপলক্ষে প্রথম একটি শোভাযাত্রা আয়োজিত হয়। অগণিত মানুষের সমাগমে সেই শোভাযাত্রা হয়ে ওঠে শহরের এক আকর্ষণীয় অধ্যায়। বর্তমানে সেই সরস্বতী পুজো প্রত্যেকবার এক নতুন ভাবনার চমকে পালিত হয়। পুরনো মন্দিরের আদলে "পাথর প্রতিমা", কখনো বা বিয়ের আদলে "ছাদনাতলা"। কোভিডের সময় সরস্বতী পুজো উপলক্ষে শহরের ডাক্তারদের সম্মানিত করা হয়।

"নানা ভাষা, নানা মত,
নানা পরিধান,
বিবিধের মাঝে দেখো
মিলন মহান।"

২০২৩ সালে উক্ত ভাবনার মধ্যে দিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করার বার্তা বহন করেছে অগ্রণী সমাজ। আসলে অগ্রণী সমাজের প্রতিটি পরিকল্পনার প্রবাহমান নদী যেন সাম্যের সমুদ্রে এসে মিশেছে ।


ক্রীড়া :-

১৯৫৪ সালে অগ্রণী সমাজের দুটি বড় অবদান এই শহরের বুকে— একটি "নেতাজি সুভাষ মেলা", অপরটি "নন্দীকেশ্বরী শিল্ড ফুটবল টুর্নামেন্ট"। এই দুটি ক্ষেত্রেই সুদীর্ঘকাল সম্পাদকের ভূমিকা পালন করেছিলেন অগ্রণী সমাজের প্রবীণ সদস্য চিত্তরঞ্জন ব্যানার্জী। এই ফুটবল টুর্নামেন্ট সহ অগ্রণী সমাজের খেলোয়াড়রা তখন নাম করে ফেলেছিলেন শহর, জেলা ছাপিয়ে আপামর রাজ্যে, এমনকি কখনো বা রাজ্যের বাইরেও। প্রখ্যাত ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় শৈলী ব্যানার্জীর খেলা শহরবাসী দেখেছেন অগ্রণী সমাজের প্রচেষ্টায়। ভারতের প্রখ্যাত গোলকিপার ক্যাপ্টেন সুমিত ঘোষ ছিলেন অগ্রণী সমাজের অত্যন্ত আপনজন। একটা সময় জেলার ক্রীড়াঙ্গনে "শম্ভু শীলা নীলা" এই ত্রয়ীর নাম ছিল সবার মুখে মুখে। শ্রী নীহার দত্ত, কমলাপ্রসন্ন দত্ত, কালিদাস মিত্র, মিহির দত্ত, নারান দত্ত সহ আরও অনেকের নাম শহর তথা জেলার ফুটবল ইতিহাসে এখনো উজ্জ্বল।


দুর্গাপুজো :-

১৯৬৮ সালে অগ্রণী সমাজের এক নতুন পথচলা শুরু হয়। অগ্রণী সমাজের প্রাণপুরুষ স্বর্গীয় শ্রী নিহার দত্তের স্ত্রী শ্রীমতি স্মৃতিকণা দত্তের ইচ্ছেতেই অগ্রণী সমাজে শুরু হয় দুর্গাপুজো। দুর্গাপুজো আসলে এই সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষকে বেঁধে রাখার এক অব্যক্ত প্রয়াস। এই প্রয়াসের সূচনা আড়ম্বরহীন হলেও তাতে আনন্দের মাত্রা কোথাও কম ছিল না। সিউড়ির শিল্পী অরূপ মিশ্রের লিনোঢাক এবং বহরমপুরের প্রখ্যাত ভাস্কর যামিনী পালের 'অকালবোধন মূর্তি' শহর তথা গ্রামাঞ্চলে আলোড়ন ফেলেছিল। তৎকালীন সময়ে পুজো উপলক্ষে কানাইলালবাবুর মিলে তিন হাজারেরও বেশি মানুষকে ভোগ খাওয়ানো হতো। এই পুজোকে কেন্দ্র করে 'পুনশ্চ' পত্রিকা প্রকাশিত হয়। তৎকালীন সময়ে এই পত্রিকার দায়িত্বে ছিলেন সুনীল দাস। এক সময় কবি জীবনানন্দ দাশের মেয়েও এই পত্রিকায় কবিতা লিখেছিলেন। আজও সাহিত্যের সেই ধারা অব্যাহত আছে। সুবর্ণ জয়ন্তী বর্ষে দুর্গাপুজো উপলক্ষে 'পুনশ্চ' পত্রিকা প্রকাশনায় কলম ধরেছিলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক ডঃ আদিত্য মুখোপাধ্যায় সহ আরও অনেক বিখ্যাত লেখক। বর্তমানে এই পুজো জেলা তথা সারা বাংলায় অন্যতম পুজো হিসেবে পরিগণিত হয়। অসংখ্য সরকারি ও বেসরকারি পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছে অগ্রণী সমাজ। তবু বন্যার জন্য ১৯৭৮ সালে এক বছরের জন্য বন্ধ থাকে অগ্রণী সমাজের পুজো।


সাংস্কৃতিক কার্যক্রম :-

অগ্রণী সমাজের শুরুর দিকে শুক্লা পঞ্চমী এবং সপ্তমীর ভোরে প্রভাতফেরি আয়োজিত হত। মূল গায়ক ছিলেন সতীন্দ্র মিত্র। কবিগুরুর লেখা "আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ" গানের সম্মিলিত সুরমাধুরীতে ঘুম ভাঙতো শহরবাসীর। নিয়মিত পালিত হতো পঁচিশে বৈশাখ, ২৩ শে জানুয়ারি সহ আরও গুরুত্বপূর্ণ দিন। তৎকালীন সময়ে সদস্য নিরাপদ রুজ ও হরিমোহন রায়ের অঙ্কনশিল্প এক অন্য মাত্রা সংযোজন করতো। অগ্রণী সমাজের উদ্যোগে শহরে প্রথমবার মণিপুরী শিল্পীদের নিয়ে আয়োজিত হয় নৃত্যানুষ্ঠান। তৎসহ সঙ্গীতশিল্পী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়-এর মতো প্রবাদপ্রতিম শিল্পীদের সারারাত ব্যাপী সঙ্গীতানুষ্ঠান পরিবেশিত হয়। আর্য অপেরা, সত্যম্বর অপেরা, নট্ট কোম্পানিরদের নিয়ে প্রথমবার সাঁইথিয়া শহরে যাত্রানুষ্ঠানের আয়োজন হয় অগ্রণী সমাজের পরিচালনায়। অগ্রণী সমাজের সেই ধারা আজও প্রবাহমান। বিভিন্ন সময়ে বিখ্যাত শিল্পীদের সঙ্গীতানুষ্ঠান, নিজস্ব নির্দেশনায় নাটক পরিবেশন, মণ্ডপ অঙ্গনে পুজোর শেষ বেলায় নিজেদের অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। বেশ কিছু বছর ধরে তৈরি হয়ে আসছে দুর্গাপুজোর ভাবনা অনুযায়ী থিম সং। প্রতিবার রাজ্য তথা দেশের প্রখ্যাত শিল্পীদের হাত ধরে শুভ উদ্বোধন হয়েছে আমাদের পুজোর। সেই তালিকায় রয়েছেন ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি শ্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের বহু তারকা। সর্বক্ষেত্রেই সাংস্কৃতিক চেতনায় শহরকে প্রাণিত করার লক্ষ্যে এখনো অবিচল অগ্রণী সমাজ।


পরিবেশ সচেতনতা :-

বিগত বছরের দুর্গাপুজোর প্যান্ডেলে বা মায়ের সাজে অগ্রণী সমাজ প্লাস্টিক ও থার্মোকলের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে বৃক্ষরোপণ ও কখনো বা "জল ধরো জল ভরো" স্লোগানের মাধ্যমে মণ্ডপসজ্জা। সর্বক্ষেত্রেই পরিবেশ সচেতনতার বার্তা শহরবাসীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করানোর প্রচেষ্টাতে অব্যাহত আছে অগ্রণী সমাজ।


কোভিডকালীন অসময়ে :-

সারা বিশ্বের কাছে ২০২০ যেন এক মৃত্যু বহনকারী বছর। ঘরের বাইরে শুধুই তখন মৃত্যুর খবর। সেই সময়ও অগ্রণী সমাজ নিজেদেরকে গৃহবন্দী রাখতে পারেনি। সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কখনো বিতরণ করা হয়েছে মাস্ক, সাবান, স্যানিটাইজার, কখনো বা প্রচারের অলক্ষে তুলে দেওয়া হয়েছে অসংখ্য মানুষের মুখে অন্নের যোগান। সব ক্ষেত্রেই অগ্রণী সমাজ শহরের অগ্রজ ভূমিকা পালন করেছে প্রতিনিয়ত।


বর্তমানে :-

দেখতে দেখতে অগ্রণী সমাজ আজ এই শহরের বুকে শুধু একটা নাম নয়, শুধু একটা প্রতিষ্ঠান নয়, এ যেন এক আস্থা, বিশ্বাস, প্রত্যাশা ও প্রেরণার আশ্রয়। প্রতিবারের দুর্গাপুজোয় মা দুর্গার সমস্ত নির্মাণ কাজ হয় অগ্রণী সমাজের মণ্ডপ জুড়ে। রথের দিনে খুঁটি পুজো শেষ হলেই মায়ের খড়ের কাঠামোতে মাটি লাগানো শুরু হয়। অসংখ্য মৃৎশিল্পীর একত্রিত প্রয়াসে এবং প্রখ্যাত শিল্পী যামিনী পালের উত্তরসূরী অসীম পালের তুলির টানে তৈরি হয় আমাদের মা। থিমের মধ্যে আধুনিকতার ছোঁয়া, আবার শিষ্টাচার মেনে ঘড়ির কাঁটার অনুবর্তী হয়ে পুজোর সমস্ত নিয়ম মেনে চলা হয়। ঐতিহ্য ও আধুনিকতার এ এক অনন্য মেলবন্ধন। ২০১৮ সালে ৫০ বছরের দুর্গাপুজোর থিম ছিল "কোনারক মন্দির"। অসাধারণ ভাস্কর্যের ছোঁয়ায় শহর, জেলা সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অগণিত দর্শনার্থীর জনস্রোত ছিল নজিরবিহীন। সেই বছর অগ্রণী সমাজের মুকুটে অসংখ্য শ্রেষ্ঠত্বের পালক সংযোজিত হয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে বীরভূম জেলার "সেরার সেরা পুজো"-র শিরোপা। সুবর্ণ জয়ন্তী বর্ষ উপলক্ষে অগ্রণী সমাজে ছিল প্রতিদিন ভোগের ব্যবস্থা। এমনিতে প্রতিবার নিয়ম করে নবমীতে ভোগ হয় মায়ের। পরবর্তী বছরগুলিতেও " মায়াডোর" , "জল ধরো জল ভরো" , "দহন" , "এবার ডোকরা" , "আদিম অতিথি" ও "শশি শেখর" উল্লেখযোগ্য। সাঁইথিয়া শহরে প্রথমবার লাইট শো- এর আয়োজন করে অগ্রণী সমাজ। ২০২৪ সালে "শশি শেখর" থিমের সময় "আদিযোগী" লাইট শো এক অন্য উন্মাদনা সৃষ্টি করেছিল সারা জেলা জুড়ে। কার্যত সারা রাত ধরেই ছিল দর্শনার্থীদের সমাগম। দুর্গাপুজো, সরস্বতী পুজো, 'অগ্রণী সঙ্গে থাকে' , 'অগ্রণী উৎসব' , ঈদ ও পুজোতে বস্ত্র বিতরণ সহ আরও নানান পদক্ষেপে এই শহর তথা গ্রামাঞ্চলের প্রতিটি মানুষের নিশ্চয়তার নিঃশ্বাসে বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকার পরতে পরতে যেন একটাই নাম— অগ্রণী সমাজ। শহরের মেঠো সম্প্রীতির ঘ্রাণে সবাই যেন সুস্থ হয়ে বেঁচে থাকে— এ আমাদের স্বপ্ন । মায়ের আগমনে তাই প্রত্যেকবারই জনসমুদ্রের অপর নাম হয়- অগ্রণী সমাজ।


আমরা বিশ্বাস করি :-

অগ্রণী সমাজ তার দুর্গাপুজোর মাধ্যমে সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষকে একত্রিত করে, একসাথে নিয়ে বাঁচাকেই জীবন এবং সমাজ বলে বিশ্বাস করে। তাই ফুটবলে স্বাস্থ্য, দুর্গাপুজোর অঙ্গনে সংস্কৃতির চেতনা, এবং নীরবে নিরন্তন করে চলা মানুষের সেবা— এই সবকিছু নিয়েই অগ্রণী সমাজ।


আমাদের লক্ষ্য :-

একটি সুস্থ সমাজই অগ্রণী সমাজের একমাত্র লক্ষ্য। বিদ্বেষহীন, বিভেদহীন, সাম্যময় ঐক্যবদ্ধ সমাজ। দুর্গাপুজো কিংবা সরস্বতী পুজোর বিভিন্ন থিমের মাধ্যমে এই বার্তা বারংবার মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে অগ্রণী সমাজ। অগ্রণী সমাজ প্রচারবিমুখ হয়ে হাত বাড়িয়ে দেয় তাদের হাতে, যাদের হাত ধরার মতো কেউ থাকে না। নিরন্তর সেই অসহায় হাত যেন আমরা একত্রিত হয়ে ধরে রাখতে পারি— এই আমাদের লক্ষ্য, এই আমাদের তপস্যা।


অগ্রণী সমাজের স্বপ্ন :-

অগ্রণী সমাজের প্রাণপুরুষ শ্রী নিহার দত্ত ছিলেন এই শহরের উন্নতির এক ও অদ্বিতীয় কারিগর। তাঁর কাছে সাঁইথিয়া শহর ছিল সন্তানসম। তাই অগ্রণী সমাজ রোজ স্বপ্ন দেখে এই শহরটার বৈপ্লবিক পরিবর্তন— সম্প্রীতি, সাম্য ও সুস্থতার শহর সাঁইথিয়া। দুর্গাপুজোর চারটি দিনের মতো ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে যেন আমরা বাঁচতে পারি সারা বছর। এই আমাদের স্বপ্ন, আগামীর স্বপ্ন।


আগামীর অগ্রণী সমাজ :-

আগামী সময়ে অগ্রণী সমাজ যাতে আরও বৃহৎ হতে পারে তার চেষ্টা আমাদের চিরন্তনী। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, উৎসব ও মানুষের পাশে থাকা— এই নিয়েই আমাদের আগামী। কালের নিয়মে অগ্রণী সমাজ নামক বাগিচায় অনেক নতুন ফুল ফুটবে। অতন্দ্র সময়ের অন্তরালে হয়তো অনেক ফুল ঝরে পড়ে যাবে, তবু থেকে যাবে অসংখ্য ইতিহাস বুকে নিয়ে আমাদের অগ্রণী সমাজ। যতদিন, যতক্ষণ, যতজন থাকবে আমাদের— তারাই এই সৃষ্টিকে সুরক্ষিত রাখবে আজীবন। আগামীর ভাবনায় সাম্য, সততা, ঐক্য ও সম্প্রীতির সম্প্রসারণ আমাদের দায়িত্ব। আগামীর হাত ধরে আমাদের দুর্গাপুজো পৌঁছে যাক দেশ সীমানার সমস্ত গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বের দরবারে। সমস্ত সু সম্পর্কের বন্ধন চিরন্তনী সম্পদ হয়ে থাকুক শহরের প্রতিটি আলোর সাথে, ভালোর সাথে, একসাথে।
বিজয়া দশমীর মতো করে অশ্রুসিক্ত চোখে আগামীর আনন্দিত আননে সহস্র কণ্ঠে উচ্চারিত হোক—
     "আসছে বছর আবার হবে"।